‘কিন্তু কেন?’ ‘কেন আমি একটা কেউটে সাপ ধরব না?’ এরকম নাটকীয় ভাবে শুরু হয় মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ময়নার গল্প- ময়না ছোট একটি মেয়ে যে সর্বদা প্রশ্ন করে। এত প্রশ্ন করে যে গ্রামের পোস্টমাস্টার তাকে ডাকে ‘কেন কেন মেয়েটি’।

ময়নার জীবনটা স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতার দ্বন্দ্বে ভরা। স্বাধীনতা হল সে বনে ঘোরাঘুরি করতে ভালবাসে আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে উপভোগ করে। ময়না আদিবাসীদের শবর সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মগ্রহন করে, যারা নিজেদের ‘জঙ্গলের সন্তান’ বলে মনে করে। বহু শতাব্দী ধরে তারা ‘সভ্যতার’ কবল থেকে তাদের আনন্দময়, নির্বিঘ্ন, ন্যায়সঙ্গত, টেকসই জীবনকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। কোন রাজা বা শাসককে কখনও স্বীকৃতি না দিয়ে তারা এক বন থেকে আরেক বনে পালিয়ে বেড়িয়েছে, তাদের ধ্বংসকারীদের ঠিক একধাপ এগিয়ে থেকে।

ময়নার জীবন আমরা যারা ওর গল্প পড়ার সুযোগ পেয়েছি, তাদের থেকে অনেক আলাদা ধরনের। সাপ ধরে রান্না করা, পাখিদের ফাঁদে ফেলা, ছাগলদের দেখাশোনা করা আর যে ‘বাবু’দের বাড়ি সে কাজ করে সেই ‘বাবু’দের ফেলে দেওয়া খাবার খাওয়া, এইসব অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের অভিজ্ঞতার থেকে খুব আলাদা। জঙ্গলে ময়নার স্বাধীনতা এবং ওর সামন্ত প্রভুর উপর ওর নির্ভরতা দুটোই যেকোনো মধ্যবিত্ত শিশুর জীবনের স্বাধীনতা ও বিধিনিষেধের চেয়ে অনেক বেশী তীব্র।

১৮৭২ সালে ব্রিটিশদের হাতে শবরদের নৃশংস অত্যাচার ও শবরদের ‘অপরাধী’ উপজাতি এই তকমার ফলে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা এখনো চলেছে আরো সূক্ষ্ম, অথচ বলিষ্ঠ উপায়ে। এই সম্পর্কে হয়ত ময়না এখনো জানে না। হয়ত সে শবর মেয়ে চুনি কোটালের কথা শুনেছে যে পড়াশুনা শেখার আগ্রহের সাহস দেখিয়েছিল। ময়নার জীবনে তার প্রতিবন্ধকতা আসে পারিবারিক পরিস্থিতি থেকে যা তাকে ছাগল চরানোর কাজ করতে বাধ্য করে। ময়না তার জীবনের অন্যায়ের পরিস্থিতি খুব দ্রুত লক্ষ্য করেঃ ‘কেন আমাকে নদী থেকে জল তোলার জন্য এতদূর হাঁটতে হবে? আমরা কেন একটি পাতার কুটিরে থাকি? আমরা কেন দিনে দুবার ভাত খেতে পারি না। আর তার পরে ‘কেন আমিও পড়াশোনা করব না?’ ময়না পৃথিবীর সম্পর্কে প্রশ্ন করতে করতে বুঝতে পারে অন্তত কিছু কিছু উত্তর বইগুলিতে পাওয়া যাবে, তাই সে স্কুলে ভর্তি হতে চায়।

মহাশ্বেতা দেবী ময়নার চরিত্রটি বহু উপজাতির ও অ-উপজাতির যে সব শিশুদের দেখেছিলেন, তাদের উপর ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেন যে উপজাতির শিশুরা প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকার দরুন স্বাভাবিক ভাবেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গ্রহন করতে সক্ষম। তবে ময়নার মত একটি শবর শিশুর পক্ষে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ পাওয়াই একটা ভাগ্যের ব্যাপার। একটি অধিকারপ্রাপ্ত পরিবারের শিশুর পক্ষে একটি অনুভূতি, একটি আশা, একটি মতামত প্রকাশ করা অথবা একটি প্রশ্ন করাতে কোন বাধা নেই। ময়নার ক্ষেত্রে এই সুযোগ এল ‘সমিতি’র দ্বারা পরিচালিত, স্কুল বহির্ভূত ক্লাসের মাধ্যমে।

এই ক্লাসগুলি, যেগুলির পটভূমিকায় ময়নার গল্প তৈরি সেগুলি ‘পশ্চিমবঙ্গ খেরিয়া শবর কল্যান সমিতি’, পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ চালায়। মহাশ্বেতা দেবী ওদের সঙ্গে তিন দশক ধরে কাজ করেছেন। এই সমিতি একটি সমাজভিত্তিক সংগঠন যা শবরদের জীবিকা, শিক্ষা ও সম্মান ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। শবররা বহু প্রজন্ম ধরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। সমিতিটি আদিবাসী গ্রামগুলিতে ক্লাস নেয় যার ফলে শবর শিশুরা আত্মবিশ্বাস অর্জন করে, নিজেদের বক্তব্য রাখতে পারে আর কিছু প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে, আর তার ফলে পরে সরকারি বিদ্যালয়ে অভ্যস্ত হতে পারে।

মহারাষ্ট্রের অমরাবতী জেলায়, পুরুলিয়ার এক হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে, একটি উপজাতি আশ্রমশালায় অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রী দুঃখজনক ভাবে সাওয়ালিরামকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ ‘মানুষ এক, তবে তারা কেন বিভিন্ন বর্ণের?

আমরা এই প্রশ্নগুলি শুধু গল্পের ময়নার কাছ থেকেই শুনিনা, আমরা এই প্রশ্নগুলি অন্য বহু শিশুর কাছ থেকে শুনি যারা বৈষম্যর শিকার হয়, যা আমাদের সমাজে সর্বত্র দেখা যায়। এই শিশুরা শুধু চায় তাদের খেলার অধিকার, তাদের প্রশ্ন করার আর শেখার অধিকার চায়, তাদের চেহারা, জামাকাপড়, ভাষা বা জন্মসূত্রের উপর ভিত্তি করে তকমা এঁটে তাদের সমাজ যেন দূরে না রাখে। আশা করা যাক যেন আরো অনেক ময়নারা তাদের অধিকারের জন্য উঠে দাঁড়ায়।

--------

১) ‘দ্য ওয়াই ওয়াই গার্ল’, মহাশ্বেতা দেবী রচিত, প্রথম প্রকাশিত হয়অ্যান ইনট্রোডাকশান টু দ্য পাফিন ট্রেজারী অফ মডার্ন ইন্ডিয়ান স্টোরিস’, সম্পাদনাঃ মালা দালাই, ২০০২। চিত্রিত শিশুদের বই, প্রকাশনাঃ তুলিকা; তামিল, ইংরাজি, মারাঠি, কানাড়া, মালায়ালাম, হিন্দি, গুজরাতি আর তেলুগু।  

২) ‘দ্য বুক অফ দ্য হান্টার’ রচনাঃ মহাশ্বেতা দেবী; অনুবাদঃ সাগরী ও মন্দিরা সেনগুপ্ত, সীগাল, ২০০২

৩) ‘চল্লিশ পয়সা মূল্যের শ্রদ্ধা’ রচনাঃ দিলীপ ডে সুজা (নভেম্বর ১১, ২০১৯ তে পাওয়া)

তুমিও প্রশ্ন সংগ্রহ বা উত্তর দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হতে পার। 

লেখক: জয়শ্রী রামদাস